এক সময়ে কওমী মাদ্রাসা ও কওমী অঙ্গনের সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র হাটহাজারী মাদ্রাসা এখন অনেকটাই কওমীদের নেতৃত্ব হারিয়েছে। বড় বড় আলেম ও বুজুর্গ ব্যক্তিদের ইন্তেকালের পর এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।
মূলত: আল্লামা শাহ আহমদ শফি ও আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর ইন্তেকালের পর থেকেই নেতৃত্ব শুন্য হয়ে পড়ে দেশের সবচেয়ে বড় খ্যাতিমান হাটহাজারী মাদ্রাসাটি।
জানা গেছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী রহ. ছিলেন কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) সভাপতি। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারী গঠিত হওয়া হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আমীর ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে গঠিত হাইআতুল উলইয়া তথা সরকার স্বীকৃত কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী রহ. উম্মুল মাদারীস খ্যাত হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম তথা প্রধান পরিচালক হওয়ায় বেফাক, হাইয়াহ্ ও হেফাজতের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে হাটহাজারী মাদ্রাসা। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. ইন্তেকালের পর শাইখুল হাদীস আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রহ. বেফাকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত না হলেও হেফাজতের আমীর নির্বাচিত হয়। এতে শিক্ষা বোর্ড বেফাক হাটহাজারীর হাতছাড়া হলেও হেফাজতে ইসলাম থেকে থেকে যায় হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণে।
২০২১ সালের ১৯ আগস্ট আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রহ. ইন্তেকাল করলে হেফাজতের আমির নির্বাচিত হয় ফটিকছড়ি বাবুনগর মাদ্রাসার মুহতামিম আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। মূলত মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হেফাজতের আমীর নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে হেফাজতের নেতৃত্ব হারায় হাটহাজারী মাদ্রাসা। এদিকে আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী রহ. এর ইন্তেকালের পর আল্লামা শাহ্ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া রহ., আল্লামা মুফতী আব্দুস সালাম রহ. বর্তমান মুহতামিম আল্লামা মুফতী খলিল আহমদ কোরাইশী বেফাক বা হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বে স্থান পায়নি। উপদেষ্টা, নায়েবে আমির পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। ক্বায়েদে মিল্লাত আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রহ. যখন হেফাজতে ইসলামের আমির ছিলেন তখন তিনি বেফাক তথা কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সহ-সভাপতি ছিলেন। আল্লামা বাবুনগরীর ইন্তেকালের পর কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এবং হেফাজতের সবই হারায় হাটহাজারী মাদ্রাসা। শিক্ষা এবং আন্দোলন সংগ্রামের কিছুই আর নেতৃত্ব নেই হাটহাজারী মাদ্রাসা হাতে।
কওমী শিক্ষাবোর্ড ও হেফাজত এখন চলে গেছে ঢাকার নিয়ন্ত্রণে। মোটামুটি বেফাক আর হাটহাজারীর নিয়ন্ত্রণে আসছে না এটা বলে মনে করছে সচেতন মহল। ওদিকে হেফাজতও চলে গেছে ঢাকার নিয়ন্ত্রণে। আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী আমির হলেও সব সিদ্বান্ত ও নিয়ন্ত্রণ ঢাকার হেফাজত নেতাদের হাতে। আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর ইন্তেকাল পরবর্তী হেফাজতের ওই নামকাওয়াস্তে নেতৃত্বও পুরোপুরি ঢাকার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে বলে মনে করছে কওমী মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হেফাজত নেতা জানান, বেফাক হাটহাজারীর হাতছাড়া হওয়ায় সমস্যা নেই, কিন্তু হেফাজত হাটহাজারীর হাতছাড়া হওয়াটা বিস্ময়ের। অন্তত হেফাজতকে প্রকৃতপক্ষে অরাজনৈতিক রাখার স্বার্থে হলেও হাটহাজারীর নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার ছিলো। যদি হেফাজতের গঠনতন্ত্র থাকতো, গঠনতন্ত্রে আমির হতে হলে হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম হওয়া শর্ত থাকতো তাহলে এমন হতো না।
বিষয়গুলো নিয়ে কী ভাবছে হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এমন প্রশ্নের জবাবে হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা আশরাফ আলী নিজামপুরী জানান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এ দেশের কোটি কোটি তৌহিদী জনতার ঈমান-আক্বিদা রক্ষার অপ্রতিরোধ্য, আধ্যাত্মিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। হেফাজত স্বয়ংক্রিয়। হেফাজতকে অরাজনৈতিক হিসেবে নিজ স্বকীয়তায় স্বস্থানে থাকতে দিন। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হেফাজতকে ব্যবহার না করার অনুরোধ করে তিনি বলেন, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রাহি. আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রাহি.সহ শহীদদের আত্মার সাথে কেউ বেঈমানি করবে এটা আমরা আশা করিনা।
মাসিক মাঈনুল ইসলাম সম্পাদক মাওলানা মুনির আহমদ জানান, ইসলামী সাংগঠনিক অঙ্গনের বর্তমান হালত ও পরিস্থিতি অবলোকন করলে আমি নির্মোহ হয়ে মন্তব্য করলে আমার বিশ্বাস, হাটহাজারী মাদ্রাসা বিতর্কিত হওয়ার সকল ঝুঁকি থেকে দূরে থেকে ইসলমি খিদমত আঞ্জামে যে মনোনিবেশ করেছে, এটাই সঠিক।
তাছাড়া শাহবাগি উৎখাত হয়েছে, খুনি হাসিনার ফ্যসিবাদ উৎখাত হয়েছে, এখন হাটহাজারী নীরবে ইলমি খিদমতে মনোনিবেশ করেছে। এটাই যথার্থ।
হাটহাজারী মাদ্রাসার নেতৃত্ব হারানোর বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন শীর্ষ আলেম জানান, আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. এর ব্যক্তিত্ব ধরে উঠে আসা হেফাজত এবং কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক হাইয়্যা হাটহাজারী মাদ্রাসার হাতছাড়া হলেও নেতৃত্বের গুরুদায়িত্বে চট্টগ্রামের আলেমদের রাখা উচিত। চট্টগ্রামকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই মনে করেন ওলামারা।
Leave a Reply